RAW : 'র' -- পর্দার আড়ালে থাকা যোদ্ধাদের কিছু সফল অভিযান
RAW : রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং , ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা গুলির একটি ।আমরা তাদের সম্পর্কে যতটা না জানি ,তার চেয়ে তারা আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জানে ! তারা সবার আড়ালে থেকে আমাদের জন্য প্রতি নিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে!যতটা জানা যায় ,তার থেকে বেছে নিয়ে আমরা পেজে RAW এর কয়েকটি টপ কভার্ট অপারেশনের কথা নীচে আলোচনা করছি ,যে অপারেশন গুলির প্রধান ভূমিকায় ছিল RAW এবং তাদের ফিল্ড অপারেটররা !
■ অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা:
স্মাইলিং বুদ্ধা ,ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের ছদ্মনাম ছিল।পুরো প্রোগ্রামটির গোপোনীয়তার ভার RAW এর আন্ডারে ছিল । এটা RAW এর সর্বপ্রথম কোন প্রজেক্ট ছিল ,যেটাকে তাদের ভারতের অভ্যান্তরে করতে হয়েছিল ।অবশেষে ১৮ মে ,১৯৭৪ সালে ভারত সফল ভাবে ১৫ কিলোটনের প্লুটোনিয়াম ডিভাইস টেস্ট করে এবং পৃথিবীর এলিট নিউক্লিয়ার গ্রুপে ঢুকে পরে।এক সাথে আমেরিকা ,চীন,পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দিয়ে ,ভারতের এই কৃতিত্ব অর্জন RAW ছাড়া অসম্ভব হত ।
■ খালিস্তান বিদ্রোহ:
আশির দশককে ভারতের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় বলা যেতে পারে ! বিভিন্ন সমস্যার সাথে সাথে ,পাকিস্তানি ISI এর মদতে খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদ চরমে পৌছে যায় । RAW এই সমস্যার সমাধানের জন্য দুটি গোপনীয় কাউন্টার ইন্টালিজেন্স টাস্ক ফোর্স।দল দুটি ছিল CIT-X এবং CIT-J । এদের মধ্যে প্রথম টিমের কাজ ছিল পাকিস্তানকে টার্গেট করা ,আর দ্বিতীয় টিমের কাজ ছিল গোপনে খালিস্তানি সন্ত্রাসী দের ক্ষতম করা । RAW এই অপারেশনে ব্যাপক সফলতা পায় ,তারা শুধু খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের ই ক্ষতম করে নি ,সাথে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর গুলিকে অস্থিতশীল করে তোলে এবং ISI কে বাধ্য করে যেকোন ধরনের অ্যাক্টিভিটি বন্ধ রাখতে।
■ অপারেশন কাহুটা:
RAW এর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং অপারেশনের একটি হল এটি ।পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কাহুটা নামক একটি ছোট শহরে ছিল খান রিসার্স ল্যাবোরটারি ,যেটি আসলে পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়েপন তৈরীর ল্যাব ছিল। ।RAW ব্যাপারটি আচ করতে পেরেছিল ,এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য তারা সেখানে যায়।তবে নিউক্লিয়ার টেষ্ট ল্যাব হওয়ায় সেখানে ঢোকা প্রায় অসম্ভব ছিল ।এরপর RAW এজেন্টরা সেই ল্যাবের নিকটেই একটি চুল কাটার দোকান খুলে বসে । সেই দোকানে ল্যাবে কাজ করা অনেক ধরনের কর্মীরা চুল দাড়ি কাটাতে আসত ।RAW তাদের সেই চুলের স্যাম্পল পরীক্ষা করে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পায় ,যেটা নিয়ে ভেতরে কাজ হচ্ছিল। RAW সাথে সাথে এর বিরুদ্ধে অপারেশন শুরুর আয়োজন করে এবং তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরাজী দেশাইকে ব্যাপারটা জানায়।কিন্তু মোরাজি দেশাই আশ্চর্য জনক ভাবে ,পাকিস্তানের তৎকালীন রাস্ট্রপতি জিয়া উল হক কে ব্যাপারটি জানায় এবং বলে ভারত কিন্তু পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে পেরেছে ।আর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই চরম বোকামির ফলে ,RAW তাদের কয়েকজন ব্যাপক দক্ষ অফিসারকে চিরতরে হারায়।পাকিস্তানের ISI তাদের গ্রেফতার করে এবং হত্যা করে ,আর তার পর থেকেই পাকিস্তান নিউক্লিয়ার পাওয়ার হাতে পেয়ে যায়।
■ অপারেশন মেঘদূত:
এই অপারেশন টি RAW এর এমন একটি অপারেশন ,যেটি থেকে বোঝা যায় ,সামান্য চোখ কান খোলা রাখলেও আপনি অনেক মানুষের জীবন বাচাতে পারেন।RAW লন্ডনের একটি গার্মেন্টস কোম্পানি যেটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর "আর্কটিক ওয়েদার গিয়ার" সরবরাহ করত ,তাদের থেকে জানতে পারে পাকিস্তানো এমনই শীতকালীন গিয়ার ঐ কোম্পানি থেকে অর্ডার করেছে । এর পরে RAW ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহে সক্ষম হয় ,যেখান থেকে তারা বুঝতে পারে পাকিস্তান সিয়াচীন গ্লেসিয়ার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এই খবর ভারতীয় আর্মিকে অ্যাডভান্টেজ দেয় ,এবং পাকিস্তান আর্মির আগেই ,ভারতীয় আর্মি সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের মূখ্য পিক গুলি দখল করে নেয়।
■ অপারেশন ক্যাকটাস:
১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে ২০০ তামিল বিদ্রোহী (PLOTE) মালদ্বীপ আক্রমন করে বসে ।ছোট্ট মালদ্বীপের সেই সক্ষমতা ছিল না ,যে সেই আক্রমণ থেকে নিজেদের বাচাবে।এর পর মালদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভারতের কাছে অনুরোধ করে ,যাতে ভারতীয় ফোর্স গিয়ে ,সেই বিদ্রোহীদের সাফাই করে।
Iএর পর RAW ,PARA SF এবং MARCOS কমান্ডোরা গিয়ে যাস্ট কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব সন্ত্রাসী দের ক্ষতম করে পুনরায় ,মালদ্বীপে গনতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়।
■ অপারেশন লিচ:
মায়ানমার সবসময়ই ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলির স্বর্গরাজ্য ছিল,তারা ভারতে যেকোনো অপরাধ করে সহজেই মায়ানমারের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিতে পারত। সামরিক শাসিত তৎকালীন মায়ানমারে ভারত একটা গনতন্ত্রী সরকার গড়তে ইচ্ছুক ছিল,কারন তাহলেই ভারত এসব বিদ্রোহীদের খুব সহজেই সায়েস্তা করতে পারত।এই কারনে RAW মায়ানমারের ভেতর একটি বিদ্রোহী গ্রুপ গড়ে তোলে ,যারা গনতান্ত্রীক সরকারের জন্য লড়বে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল KIA অথবা কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি ।RAW তাদের সাথে বানিজ্য শুরু করেছিল,তারা KIA থেকে মূল্যবান পাথর কিনত এবং প্রয়োজনে অস্ত্র ও সরবরাহ করত। কিন্তু KIA বিশ্বাসঘাতকতা করে ,নর্থ ইস্ট ভারতের বিদ্রোহী গ্রুপদের অস্ত্র দিতে লাগল ।আর তার পরেই RAW এই KIA নিধন যজ্ঞে নেমে পরে,যার নাম অপারেশন লিচ।১৯৯৮ সালে ছয় টপ বিদ্রোহী লিডারকে হত্যা করে RAW এবং ৩৪ গেরিলা ফাইটারকে বন্ধী করে।
■ জাতিবিদ্বেস বিরোধী অপারেশন :
RAW এর এই অপারেশন সম্পর্কে খুব বেশি না জানা গেলেও ,এটুকু জানা যায় যে RAW আফ্রীকার কয়েকটি দেশে জাতিবিদ্বেস বিরোধী অভিজানে ব্যাপক ভাবে জড়িত।RAW এর প্রাক্তন অফিসাররা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নামাবিয়া সহ আরো কয়েকটি দেশের গভার্মেন্ট ইন্টালিজেন্স টিম দের ট্রেনিং দিচ্ছে ,যাতে তারা জাতিবিদ্বেস অ্যাক্টিভিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
■ স্ন্যাচ অপারেশন :
RAW এবং IB একত্রিত হয়ে এই ধরনের বহু অপারেশন করেছে ।এটি হল এমন একটি অপারেশন ,যেটি বিদেশে কোন টার্গেটকে ধরে ,তাকে কোন গোপন জায়গায় জিজ্ঞাসা বাদ এবং প্রয়োজনে ক্ষতম ও করা যায়।শুধুমাত্র বিগত দশ বছরেই RAW এরকম ৪০০ এর ওপর স্ন্যাচ অপারেশন করেছে ,যেগুলি ভারতের সবকটি প্বার্শবর্তী দেশে বেশি সংগঠিত হয়েছে।এদের মধ্যে আমার জানা আছে এমন কয়েকটি সফলতা হল ,যেমন খালিস্তান কামান্ডো ফোর্সের জঙ্গী ভুপেন্দ্র সিং বুধা ,লস্কর জঙ্গী তারিক মাহমুদ ,আব্দুল করিম টুন্ডা ,শেখ আব্দুল খোয়াজা (২৬/১১ হ্যান্ডেলার),ইয়াসিন ভাটকাল ইত্যাদী।এদের সবাইকে RAW বিদেশে গ্রেফতার করে।
■ ১৯৭১ ,বাংলাদেশ সৃষ্টি:
এই ঘটনা সবাই জানেন ,তাই নতুন করে কিছু বলার নেই ।তবে RAW আর ISI এর যুদ্ধে ,RAW এমন ভাবেই জয়ী হয়েছে যে ,তার মূল্য পাকিস্তানকে বিভক্ত করে দিতে হয়েছে।পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে অত্যাচারিত বাঙালি জনজাতির স্বাধীনতার অন্যতম কান্ডারি।
এগুলি ছিল RAW এর সেই শত শত অপারেশনের মাত্র কয়েকটি ,যেগুলি আপনি আমি জানি ।প্রতি নিয়ত আড়ালে থেকে ছায়া যুদ্ধ চালাচ্ছে RAW ।তাতে এরা নিজের জীবনের ও পরোয়া করছে না এবং সবচেয়ে বড় কথা অধিকাংশ RAW অফিসাররাই গোপনে থেকে যান ,এমনকি মৃত্যুর পরেও তারা গোপনেই চলে যান ।কারন তার পরিচয় প্রকাশ পেলে তা তার ,পরিবারের ও ক্ষতি করতে পারে।তাই এই সব পর্দার আড়ালের বীরদের আত্মত্যাগের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
Comments
Post a Comment