রাফ্যালে ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার জেট।আর সেই জেট ক্রয়েই সরকারের দুর্নিতী?আসুন জেনে নিই ভেতরের ঘটনা।
২০১৯ এ ভারতীয় লোকসভা ভোটে,বিরোধী দল গুলির অন্যতম ইস্যু ছিল 'রাফ্যালে স্ক্যাম'।সমস্ত ইস্যুটা আরো আরো বেশি চোখ রাঙায় যখন কংগ্রেস আমলের রাফ্যালে এবং বি.জে.পি এর আমলের রাফ্যালে মূল্যেতে আকাশ পাতাল পার্থক্য পাওয়া যায়।
■ এই চুক্তি নিয়ে ভারতের বিরোধীদের মূল তিনটি প্রশ্ন ছিল :--
১. কেন প্রতিটা রাফ্যালে ₹৫৬২ কোটির বদলে,₹১৬৭০ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে হল ?
২. ১২৬ টা জেটের বদলে ৩৬ টা কেন?
৩. HAL কে বাদ দিয়ে কেন ঋণগ্রস্ত অনিল আম্বানিকে ₹৩০,০০০ কোটির কন্ট্রাক্ট দেওয়া হল ?
" প্রথমত এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন দায়বদ্ধতা সরকারের নেই।কারন ২০১৯ এর পুরো লোকসভা ভোটের প্রচারই হয়েছে -- 'রাফ্যালে একটি দূর্নীতি' প্রমাণ করার চেষ্টায়।এই কেস সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গেছে।সুপ্রিম কোর্ট পরিস্কার বলেছে রাফ্যালে চুক্তিতে কোন দূর্নীতির ঘটনা পাওয়া যায় নি।সর্বোপরি লোকসভা ভোটে দেশের জনগন,তাদের ভোটের মাধ্যমে,দেশকে সামরিক ভাবে দূর্বল করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জবাব দিয়েছে। "
ওপরের এই অংশটুকু যদি বর্তমান সরকারের কোন নেতা বলে,তাকে দোষ দেওয়ায় কিছু নেই।কিন্তু দেশের একটি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে আমাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে সাধারণ জনগণের প্রতি,যাতে তারা কোন বিভ্রান্তির মধ্যে না পরে এবং রাফ্যালে চুক্তি নিয়ে কোন সঠিক তথ্য জানতে পারে।
★★★ কেন প্রতিটা রাফ্যালে ₹৫৬২ কোটির বদলে,₹১৬৭০ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে হল ?
প্রথমত এটা বলাই ভুল যে কংগ্রেস আমলে প্রতিটি রাফ্যালে এর দাম ছিল ₹৫৬২ কোটি আর বি.জে.পি এর আমলে তার দাম ₹১৬৭০ কোটি।পুরো বাক্যটাই অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর।
প্রথমত কংগ্রেস আমলে কোন রাফ্যালে চুক্তিই হয় নি।তাহলে কি করে কংগ্রেসের সময়ে রাফ্যালের দাম ₹৫২৬ কোটি টাকা করে ছিল?কংগ্রেস আমলে সর্বপ্রথম যখন MMRCA এর জন্য আর্থিক সম্মতি প্রদান করে সেটা ২০০৮ সালে --- ১২৬ টি জেটের জন্য মোট ৭.৮ বিলিয়ন ডলার।কিন্তু এই MMRCA চুক্তি সর্বমোট দশ বিলিয়ন ডলারে এসে দাড়ায়।কিন্তু ক্রমাগত টেন্ডার প্রকৃয়া বিলম্বিত হবার কারনে এবং বছরে বছরে টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট হওয়ার কারনে বায়ুসেনার চাহিদার ও পরিবর্তন আসতে থাকে।২০১৩ সাল আসতে আসতে কংগ্রেস সরকারের MMRCA টেন্ডার এর মূল্য ৫০% বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে।২০১৪ আসতে আসতে সেই মূল্য ৩০০% বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ৩০ বিলিয়নে।অর্থাৎ যখন ২০১৪ সালে কংগ্রেস সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ.কে. অ্যান্টোনি বলেছিলেন -- আমাদের এখন রাফ্যালে কেনার বাজেট নেই,তখন যদি ১২৬ টি রাফ্যালের ডিল হত,তাহলে তাদের মূল্য হত ত্রিশ বিলিয়ন ডলার।তাই কোন হিসাবে প্রতিটি রাফ্যালের দাম ₹৫৬২ কোটি টাকা করে হয়,তার কোনও পরিস্কার চিত্র পাওয়া যায় না।
■ এবার যদি ভারত সরকারের ২০১৬ সালে করা রাফ্যালে চুক্তি ও ২০১৫ সালে করা মিশর ও কাতারের চুক্তি দেখি,তাহলে দেখা যাবে :--
● মিশরের ২৪ টি রাফ্যালে র দাম €৫.২ বিলিয়ন ইউরো।অর্থাৎ প্রতিটি রাফ্যালের দাম প্রায় ২১৬ মিলিয়ন ইউরো।
● কাতারের ২৪ টি রাফ্যালের দাম €৬.২ বিলিয়ন ইউরো,অর্থাৎ প্রতিটি রাফ্যালের দাম প্রায় ২৬০ মিলিয়ন ইউরো
● ভারতের ৩৬ টি রাফ্যালের দাম €৭.৮ বিলিয়ন ইউরো,অর্থাৎ প্রতিটি রাফ্যালের দাম ২১৬ মিলিয়ন ইউরো।
এবার রাফ্যালে ব্যাবহারকারী দেশ গুলির মধ্যে একমাত্র ভারত ও কাতারে রাফ্যালে গুলি F-3R স্টান্ডার্ড এ আপগ্রেডেশন করা আছে।অর্থাৎ ভারত ও কাতারের রাফ্যালে,মিশর অথবা ফ্রান্সের রাফ্যালের তুলনায় বেশি উন্নত।এই প্রতিটি দেশ তাদেল মোট চুক্তির মধ্যে,ওয়েপন প্যাকেজ,মেইনট্যানেন্স সহ বিভিন্ন নিজস্ব আপগ্রেডেশন যুক্ত করে নিয়েছে।সেক্ষেত্রে ভারতের রাফ্যালে নিউক্লিয়ার স্ট্রাইকে সক্ষম অথচ,কাতারে রাফ্যালে তা পারে না।এই ধরনের অনেক গুলি আপগ্রেডেশন হয়েছে রাফ্যালে গুলিতে।তার পরেও,ভারতের রাফ্যালের তুলনায় কাতারের রাফ্যালের দাম বেশি কেন?কারন ফ্রান্স ভারতকে ২৫% ছাড় দিয়েছে এই রাফ্যালে চুক্তিতে।
যদি ফ্রান্সের দিকে তাকাই,তাহলে দেখব তারা সম্পূর্ণ রাফ্যালে প্রোগ্রামে €৪৬ বিলিয়ন খরচ করেছে এবং ২৮৬ টি রাফ্যালে সার্ভিসে রেখেছে তাদের বহরে।এই ছেচল্লিশ বিলিয়নের মধ্যে অর্ধেক টাই ফ্রান্স রাফ্যালে প্রোগ্রামের রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট এ খরচ করেছে।আর তাই ভারতের সাত আট বিলিয়ন ডলারের খরচে তারা ২০০৮ সালের MMRCA চুক্তিতে ভারতকে ফুল টেকনোলজি ট্রান্সফার করবে,এমনটা ভাবাটা অন্যায়।এই ফুল টেকনোলজি ট্রান্সফারের মধ্যে ইঞ্জিন এবং রাডারের মতো কঠিন টেকনোলজি রয়েছে।কংগ্রেস নেতারা যেভাবে ফুল TOT , ফুল TOT বলে চেচাচ্ছে,তারা কি ভাবছে,যে ফ্রান্স ২০০৭ এ এই সব টেকনোলজি ভারতকে দিয়ে দিত????
২০০৭ এর রাফ্যালে চুক্তির সাথে ২০১৬ এর রাফ্যালে চুক্তির তুলনা টানা যাবে না।কারণ ২০০৭ এর চুক্তিতে আমরা রাফ্যালে র সাথে ---
● মিটিওর ক্রুজ মিসাইল
● স্ক্যাল্প ক্রুজ মিসাইল
● এ.ই.এস.এ রাডার
পেতাম না।কারন এগুলি ফ্রান্সই অনেক পরে,তাদের বহরে যুক্ত করেছে।তাই দুই সময়ের চুক্তির মধ্যে তুলনা করা কখনই যুক্তিসম্মত নয়।
■ ভারতীয় রাফ্যালে চুক্তিতে কোথায় কত খরচ হয়েছে:--
● ২৮ টি সিঙ্গেল সীট রাফ্যালে (প্রতিটির দাম €৯১.০৭ মিলিয়ন) + ৮ টি ডুয়াল সীট রাফ্যালে (প্রতিটির দাম €৯৪ মিলিয়ন)+লাইফ সাইকেল কস্ট = €৩.৩ বিলিয়ন।
● ভারতীয় চাহিদার আপগ্রেডেশন = €১.৭ বিলিয়ন।
● স্পেয়ার পার্টস+অতিরিক্ত ইঞ্জিন = €১.৮ বিলিয়ন
● ওয়েপন প্যাকেজ = €৭০০ মিলিয়ন
● লজিস্টিক (রানওয়ে+হ্যাঙ্গার ইত্যাদী) = €৩৫০ মিলিয়ন
অর্থাৎ মোট খরচ €৭.৮ বিলিয়ন ইউরো।অর্থাৎ প্রতিটি ভারতীয় রাফ্যালের পেছনে প্রায় €২১৬ মিলিয়ন খরচ হবে।
তাই ২০০৮ এর টেকনোলজির রাফ্যালের দাম ধরে,২০১৬ এর টেকনোলজির রাফ্যালে এর তুলনা করতে যান তাহলে বোকামি করবেন।দুটি চুক্তির চাহিদাও সম্পূর্ণ ভীন্ন এখানে।
■ ১২৬ টা জেটের বদলে ৩৬ টা কেন ?
বায়ুসেনা ২০০১ সাল থেকে ১২৬ টি জেট কেনার প্রকৃয়া শুরু করে।আপনারা ২০১৪ এসে যখন শেষ করেন,তখন সেই ১২৬ টি জেটের মূল্য ত্রিশ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে।পুরো টেন্ডার প্রকৃয়া একটা বিরাট তালগোল পাকিয়ে গেছে।তা ছাড়িয়ে যদি ১২৬ টি ফাইটারের চুক্তি করতে হত,তাহলে কবে তা হত তার কোন গ্যারান্টি ছিল না।অথচ সেই সময় বায়ুসেনার এমারজেন্সী ফাইটার দরকার হয়ে পরেছিল।আর তাই দ্রুত ফাইটার কিনতে দ্রুত ৩৬ টি রাফ্যালে কেনা হয় G2G প্রকৃয়ায়,যাতে যত দ্রুত সম্ভব ফাইটার জেট ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে তুলে দেওয়া যায়।
■ HAL কে বাদ দিয়ে কেন ঋণগ্রস্ত অনিল আম্বানিকে ₹৩০,০০০ কোটির কন্ট্রাক্ট দেওয়া হল ?
এর উত্তর জানতে হলে আগে আপনাকে 'অফসেট' কি তা বুঝতে হবে।আর এই অফসেটের নিয়ম UPA আমলেই তৈরী হয়েছিল,NDA এসে তার আরো সংশোধন করে।
অফসেট হল ভারতীয় সমরাস্ত্র চুক্তিতে বিদেশী কোম্পানি গুলিকে দিয়ে একটি কাজ করানো,যাতে কিছুটা হলেও চুক্তির টাকা দেশে থাকে।মূল নিয়ম হল -- যে বিদেশী কোম্পানি গুলি ভারতের সাথে সমরাস্ত্র চুক্তি করবে,সেই চুক্তি মূল্যর নির্দিষ্ট একটা টাকার খরচ সেই কোম্পানি গুলিকে ভারত থেকেই করতে হবে।অর্থাৎ ধরুন কোন কোম্পানি যদি ভারতের সাথে ছয় বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে,তাহলে ধরুন যে তার মধ্যে থেকে এক বিলিয়ন ডলারের খরচ ঐ কোম্পানি ভারতে থেকেই করবে ,অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি কে কোন পার্টস বানিয়ে,বা ভারত থেকে কোন কিছু কিনে ইত্যাদী ভাবে।UPA আমলে এই অফসেটের নিয়ম ছিল ৩০%,NDA আমলে এসে তা ৫০% করা হয়েছে।অর্থাৎ ডাসল্ট ভারতের সাথে যে রাফ্যালে ডিল করছে,সেই চুক্তি মূল্যর অর্ধেক খরচ তাদের ভারতের মধ্যে করতে হবে।অর্থাৎ এতে করে ভারতীয় কোম্পানি গুলিও বিদেশী চুক্তির মাধ্যমে লাভবান হবে।
ভারতে রাফ্যালে ডিলের যে অফসেট খরচ হচ্ছে,তা ভারতীয় টাকায় প্রায় ₹৩০,০০০ কোটি টাকা।এই টাকাটা ডাসল্ট এই পুরো টাকাটা ভারতে খরচ করবে।কিভাবে করবে তারা?ধরুন তাদের কোন এয়ারক্রাফ্ট এর জন্য একটা পার্টস দরকার।যেটা ফ্রান্সে বানালে অনেক বেশি খরচ,সেটা ভারতের কোন কোম্পানি থেকে তারা তৈরী করিয়ে নেবে।এভাবে ডাসল্ট তাদের চাহিদা মত ভাবে ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি তে ₹৩০,০০০ কোটি টাকা খরচ করবে।
ভারতে বিরোধীরা বলেছে -- সরকার পুরো ত্রিশ হাজার কোটি টাকায় অনিল আম্বানির রিলায়েন্স কে দিয়েছে।ব্যাপারটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়।ডাসল্ট তাদের অফসটে পরিকল্পনায় ভারতের অন্তত ১০০ টি কোম্পানি কে রেখেছে।যার মধ্যে HAL সহ বিভিন্ন সরকারি কোম্পানি ও বেসরকারি কোম্পানি (Mahindra, Samtel, BTSL Automotive India, Defsys Solutions, Maini Aerospace, Kinetic India and Reliance)
রয়েছে।এই কোম্পানি গুলির একটি রিলায়েন্স, যারা মোট অফসেট পরিকল্পনার মাত্র ৩% পাবে।তাহলে ₹৩০০০০ কোটির ৩% কত হয়?সেটাই রিলায়েন্স এর সাথে চুক্তি মূল্যে।
আশা করা যায় ভারতের রাফ্যালে চুক্তি নিয়ে মোটামুটি একটা স্বচ্ছ ধারণা আপনাকে দিতে পেরেছি।
Comments
Post a Comment