ভারতের নিউক্লিয়ার শক্তির যাত্রা।

হাইড্রোজেন বম্ব বা থার্মো নিউক্লিয়ার ওয়েপন সাধারণ পারমাণবিক বোমা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং মারাত্মক হয়ে থাকে । সাধারণ পারমাণবিক বোমা কাজ করে ফিশন প্রকৃয়ায়।ফিশন কথার অর্থ বিভাজন ।এই প্রকৃয়ায় একটি ভারী  পরমানুকে দ্রুত গতির একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে তাকে বিভাজিত করে এবং শক্তি উৎপন্ন করে ।


         অপরদিকে হাইড্রোজেন বম্ব কাজ করে ফিউশন প্রকৃয়ায় , ফিউশন শব্দের অর্থ গলন। অর্থাৎ, দুটি হালকা ভরের ডিউটেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম (হাইড্রোজেনের আইসোটোপ) পরমানুর দ্রুত গতিতে মিথস্ক্রিয়ার ফলে তুলনামুলক একটি ভারী পরমানু (হিলিয়াম) ও বিপুল পরিমানে শক্তি উৎপন্ন হয়, একে ফিউশন বিক্রিয়া বলা হয়। আমাদের অতি পরিচিত সূর্য এর উৎকৃষ্ট উদাহরন, যেখানে অনবরত ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম থেকে হিলিয়াম ও শক্তি উৎপন্ন হয়। এই ফিউশন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে যে অস্ত্র উৎপন্ন করা হয় তাকে বলা হয় থার্মোনিউক্লিয়ার বম্ব, যা হাইড্রোজেন বম্ব(H-Bomb) , আর এই হাইড্রোজেন বম্ব , প্রচলিত পারমানবিক বম্ব থেকে অনেক শক্তিশালী ।

     ভারতের নিউক্লিয়ার আর্সেনালে বর্তমানে তিন ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়েপন আছে -

১. থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়েপন ।

২. ফিউশন বুস্টেড ফিশন বম্ব ( এতে ওয়েপন গ্রেড এবং রিয়াকটর গ্রেড প্লুটোনিয়াম ব‍্যাফহার করা হয় )

৩. ফিশন প্লুটোনিয়াম বম্ব ( লো ইয়েল্ড এবং হাই ইয়েল্ড )

     ভারতের প্রথম নিউক্লিয়ার টেস্ট  যা অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধ নামে পরিচিত।এটি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৮ মে , ১৯৭৪ সালে সংগঠিত হয় এবং ভারত পৃথিবীর ষষ্ঠ নিউক পাওয়ার ক্ষমতার দেশ হয় ।

      একনজরে ভারতের নিউক যাত্রা ----

১৯৬২ : চীনের সাথে যুদ্ধে ভারত ৪০০০ এর ওপর সোলজার হারায় ।

১৯৬৪ : চীনের প্রথম নিউক্লিয়ার বম্ব টেষ্টের পর , পার্লামেন্টে অটলবিহারী বাজপেয়ী জি বলেন - " অ্যাটম বম্বের জবাব অ্যাটম বম্ব ই হ‌ওয়া উচিত !" 

১৯৭৪ : ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারত নিউক্লিয়ার পাওয়ার কান্ট্রি রূপে নিজেকে প্রকাশ করল ।

১৯৭৪ : এই সময় থেকে রাজিব গান্ধী এবং পরে ভিপি সিং ভারতের টপ সিক্রেট নিউক্লিয়ার পাওয়ারের আরো উন্নতি ঘটাতে লাগলেন গোপনে।

১৯৯৫ : নরশিমা রাও এর সময়ে ভারত হাইড্রোজেন বম্বের দোড় গড়ায় পৌছে যায় ।তবে আমেরিকান CIA তাদের স্পাই স‍্যাটেলাইট দ্বারা ভারতের এই অ্যাক্টিভিটি ধরে ফেলে ,এবং আমেরিকা ভারতকে আন্তর্জাতিক অবরোধের হুমকি দেয় ।

১৯৯৬ : আমেরিকান গোয়েন্দা এজেন্সী গুলি ভারতের পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রমান হাতে নাতে সংগ্রহ করে ,এবং ভারতকে আন্তর্জাতিক অবরোধের দিকে ঠেলে দিতে থাকে ।

১৯৯৬-১৯৯৮ : অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রী হিসেব উথ্বান এবং আমেরিকার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে হাইড্রোজেন বম্ব তৈরীর নির্দেশ ।

২০ মার্চ , ১৯৯৮ : বাজপেয়ী গোপনে তৎকালীন DRDO চীফ ড: এপিজে আব্দুল কালাম ,অ্যাটোমিক এনার্জী চিফ ড: আর চিদম্বরম  , BARC প্রধান ড: অনিল কাকোডকার , NSA ব্রজেশ মিশ্র , গৃহমন্ত্রী এল কে আডবানীর সাথে দিল্লীর সাউথ ব্লকে  মিটিং করেন।

৮ এপ্রিল , ১৯৯৮ : দ্বিতীয় বারের মতো সেকেন্ড মিটিং এর পর বাজপেয়ী নিউক্লিয়ার টেস্টের অর্ডার দেন। 

২৭ এপ্রিল,১৯৯৮ : টেস্টের ডেট পিছিয়ে দেওয়া হয়  ড: চিদম্বরমের মেয়ের বিয়ের জন‍্য ।এটা করার কারন ছিল ,যাতে কেও সন্দেহ না করে বিয়েতে তার অনুপস্থিতি নিয়ে  ।

৭ মে,১৯৯৮ : BARC থেকে সমস্ত ইকুইপমেন্ট বিমানে করে জয়সালমীর এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয় ।সেখান থেকে আর্মি ট্রাকে করে টেস্ট রেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় ।

১১-১৩ মে , ১৯৯৮ : মোট পাচবার থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়েপন টেস্ট হয় ।

    এবং এভাবেই ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রের মালিক হয় আমেরিকার CIA এর নাকের ডগায় । DRDO এর বিজ্ঞানিরা ক‍্যালকুলেট করতেন CIA এর স‍্যাটেলাইট কখন ভারতের ওপর দিয়ে যাবে , এবং ঐ সময় সমস্ত ইঞ্জিনিয়াররা টেস্টিং রেঞ্জে  তাদের কাজ বন্ধ করে রাখত ,প্রায় সমস্ত কাজ হত রাতের বেলায় ।টেস্ট রেঞ্জে আর্মি কম বিজ্ঞানী বেশি থাকত ,এবং তারা সর্বদা আর্মির ড্রেসে থাকত ,যাতে স‍্যাটেলাইট থেকে দেখে ব‍্যাপার গুলি আর্মির অ্যাক্টিভিটির বেশি কিছু না লাগে ।ড: এপিজে কালামের ছদ্মনাম ছিল মেজর জেনারেল পৃথ্বীরাজ । ভারতের সফল থার্মোনিউক্লিয়ার টেস্টের পর ,এটি ভারত জনসম্মুখে আনার পর CIA তাদের গোয়েন্দাগীরির ব‍্যার্থতা স্বীকার করে নেয় অফিসিয়ালি ।

    পরবর্তীতে CIA ডিরেক্টর জর্জ টেনেট ( ১৯৯৬-২০০৪) এর বক্তব্য ছিল :--

     "We have been following the Indian nuclear programme for several years but there’s no getting around the fact that in this instance we missed and did not predict the particular tests in place. Simply stated, we did not get it right. It is my responsibility to stand up and tell the American people that we did not get it right."


Comments