ভূস্বর্গের বাসিন্দারা আজও ভুস্বর্গ ছেড়ে রিফিউজি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।এক রক্তাক্ত স্বর্গের কাহিনী।
নিজ ভূমে পরবাসী হয়েছে যারা .......
■ পৌরানিক কাহীনি এবং নাম করন ■
কাশ্মীর শব্দের অর্থ হল শুকিয়ে যাওয়া ভূমি। অনেক অনেক দিন আগে চারদিকে হিমালয় আর পীর পাঞ্জল পাহাড় ঘেরা এই এলাকা ছিল বিশাল এক হ্রদ। রাজা দক্ষ তনয়া সতী’ র হ্রদ নাম অনুসারে নাম ছিল সতীসর। সেই হ্রদে বাস করত এক দৈত্য। নাম তার “জলোদ্ভব” দৈত্যের অত্যাচারে লোকজন থাকত সন্ত্রস্ত। অবশেষে কাশ্যপ ঋষি এগিয়ে এলেন তাদের সাহায্য করতে। কাশ্যপ ছিলেন ব্রহ্মাপুত্র মারিচের ছেলে। যে সাতজন মুনি বা ঋষিকে সপ্তর্ষি বলা হয়ে থাকে তাদের একজন হলেন ব্রাহ্মন ঋষি কাশ্যপ।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ অনুসরনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন কাশ্যপ। ঋষি কাশ্যপের আবেদনে তুস্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু এগিয়ে এলেন। বিশাল এক বরাহের রুপ নিয়ে গুতো দিয়ে ভেঙ্গে ফেললেন এক দিকের পাহাড়। ফলে হ্রদ গেল শুকিয়ে আর মারা গেল সেই দৈত্য । যেখানে বরাহরূপী বিষ্ণু পাহাড় ভেঙ্গেছিলেন তার নাম হল বরাহমুল, যা এখন বারমুলা নামে পরিচিত। হ্রদ শুকিয়ে জেগে ওঠা পাহাড় ঘেরা এই উপত্যকাই হল কাশ্মীর উপত্যকা। লোকজনের বসতি গড়ে উঠলো নতুন জেগে ওঠা এই উপত্যকায় । কাশ্যপ ঋষির দেশ বা “কাশ্যপ-মার” থেকে ক্রমশ নাম হল কাশ্মীর।
ঋষি কাশ্যপের আমন্ত্রনে সারা ভারত থেকে লোকজন এসে বসতি গড়ে তুললো এই উপত্যকায় যারা কালক্রমে হলেন কাশ্মীরি পন্ডিত। নিলমত পূরান এবং ১২ শ শতাব্দীতে কালহান রচিত গ্রন্থ “রাজতরঙ্গীনি” কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে রচিত আদি গ্রন্থ। চীনা পর্যটক “হিউ-এন-সাং” এর বইয়ে এই এলাকার পরিচয় মেলে “ কা-শি-মি লো” রুপে আর প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসে বলা হত “কাস্পেরিয়া” মহাভারতে উল্লেখ আছে কাম্বোজ রাজাদের অধীন ছিল এই এলাকা। কাম্বোজরা ছিলেন ভারত এবং পারস্য হতে উদ্ভূত জাতি গোষ্ঠি। পাঞ্চাল রাজবংশ রাজত্য করতেন এই এলাকায় যেখান থেকে পাহাড় শ্রেনীর নাম হয় “পাঞ্জল” পরে মুসলীম শাসনামলে “পীর” শব্দ যুক্ত হয় যা থেকে নাম হল “পীর পাঞ্জল” ।
■ ইতিহাস ■
মৌর্য্য সম্রাট অশোক কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের গোড়া পত্তন করেন (খৃঃপূঃ ৩য় শতাব্দী) তখন বৌদ্ধ ধর্ম ছিল এই এলাকার প্রধান ধর্ম। ৮ম শতাব্দীর শেষে বা ৯ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিখ্যাত হিন্দু পন্ডিত শঙ্করাচার্য কাশ্মীরে আসেন। কথিত আছে যে “সারদা পীঠ” মন্দিরের চার দিকের চার দরজার দক্ষিন দরজা বন্ধ থাকত, কারন ভারতের দক্ষিন থেকে কোন পন্ডিত এই মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পায় নি। শঙ্করাচার্য্য তর্কযুদ্ধে মন্দিরের পন্ডিতদের পরাজিত করে দক্ষিন দরজা দিয়ে এই মন্দিরে প্রবেশ করেন। অভিনব গুপ্ত ছিলেন ১০ম শতাব্দীতে কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত দার্শনিক পন্ডিত।
কাশ্মীর মুসলিম শাসনাধীনে আসে চতুর্দশ শতাব্দীতে। মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান থেকে নৃশংস সেনাপতি দুলুচা ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে “যোজিলা” গিরিপথ দিয়ে এসে কাশ্মীর দখল করে নেন। দুলুচা তার চলার পথে সমস্ত শহর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংশ করে দেন। বস্তুত এই সময় থেকেই কাশ্মীরে হিন্দু রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ইসলামগ্রহনকারী রাজা রিনচিন ছিলেন প্রথম মুস্লিম শাসক । এরপর শাহ মীর ক্ষমতায় আসেন। কাশ্মীরের মুসলিম শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন ছিলেন সহনশীল কিন্তু বেশিরভাগ মুসলিম শাষক ছিল চরম অসহিষ্ণু। সিকান্দার বুশতিখান(১৩৮৯-১৪১৩) ছিলেন চরম অত্যাচারী। তিনি সমস্ত মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন এবং হিন্দুধর্ম নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। অনেক পন্ডিত কাশ্মীর ছেড়ে পালান, অনেকে করেন আত্মহত্যা।১৫৮৬ সালে কাশ্মীর মোগল শাসনাধীনে আসে। মোগলদের হাত থেকে কাশ্মীর চলে যায় আফগানী দুররানী সম্রাটদের হাতে।
■ সংখ্যা গুরু হিন্দু দেশে সংখ্যা লঘু হিন্দু ■
কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা হল আদি কাশ্মীরী - কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা। আগে বেশ কয়েক দফায় এই সম্প্রদায়ের লোকজন কাশ্মীর থেকে পাতাতাড়ি গুটিয়ে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বেঁধেছে। এখন এরা তাই সংখ্যায় খুবই কম - মাত্র পাঁচ কি ছয় লাখ হবে। ভোটের দেশে চিরকালের মত এখানেও সংখ্যালঘুদের পাত্তা এমনিতেও কম – তার ওপর যদি জায়গাটা হয় কাশ্মীরের মত “Disputed”।
১৯৮৯ সালে যখন প্রথম কাশ্মীরে সংঘর্ষ শুরু হল, তখন প্রথম আক্রান্ত হয় এই পণ্ডিতেরাই। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এদের প্রক্সি দাঁড় করিয়ে শুরু হয় জঙ্গীদের অত্যাচার। মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা শুরু হয় পণ্ডিতদের ঘরছাড়া করার আদেশ। শুরু হয় যাকে বলা হয় এথনিক ক্লিনসিং - বছরের পর বছর সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে খেলা চলে এসেছে তারই আরো এক দফা। একের পর এক পণ্ডিতকে দলে দলে মারা শুরু হয় - কোথাও গলায় দড়ি দিয়ে, কোথাও গুলি করে, কখনো হাত-পা কেটে আর কখনও বা জ্যান্ত পুড়িয়ে। এসব লোমহর্ষক কাহিনী এখন আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে - স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে শুধু উদ্বাস্তু পণ্ডিতেরা যারা কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে আছে জম্মু আর দিল্লীর কিছু রিফিউজি ক্যাম্পে।
সংখ্যার খাতিরে বলে রাখা ভাল - ১৯৮৯ সালের পরে কাশ্মীরে হামলায় মৃত ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হলেন সম্প্রদায়ভুক্ত (অত্যাচার করে মারার ঘটনা প্রায় ১,১০০র মত) আর রিফিউজি-র সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে (সরকারি ভাবে যদিও সংখ্যাটা এক-দেড় লাখের বেশী নয়)। আক্রান্ত প্রায় একশো মন্দিরের মধ্যে অনেকগুলোই এখন পরিত্যক্ত। জংগীদের ঠেলায় কাশ্মীর উপত্যকার শতকরা নব্বই থেকে পচানব্বই ভাগই এখন থাকেন জম্মু আর দিল্লীর ক্যাম্পে - ত্রিপলের তাঁবুতে।
আরো মজার কথা, যারা ছিলেন এই গণহত্যার দায়িত্বে, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন গণহত্যার কথা। যেমন ধরা যাক ইয়াসিন মালিক বা
"বিট্টা কারাটে"র (ফারুক আহমেদ দার) কথা। এরা গণহত্যার পরে এখন হিরো হয়ে বেঁচে আছেন। কাল "বিট্টা কারাটে"র ইন্টারভিউ দেখলাম ইউটিউবে। শান্ত গলায় সে দাবী জানাল সে কুড়ি জনকে মেরেছে - আর তার জন্য সে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ফাঁসির সাজা আশা করছে (২০০৬ সালে ছাড়া পেয়েছে ফারুক, এখনো কাশ্মীরে আছে)। বিবিসির সাথে ইন্টারভিউতে একইভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন ইয়াসিন মালিকও , কিন্তু এদের বিচারের ব্যবস্থা নেই ।
----- রাজনীতির মসনদে যারাই বসেছেন - তারাই ভুলে গেছেন কাশ্মীরি পন্ডিত দের অধিকারের কথা ।যাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে তেমন ভাবেই ,যেমনটা হিটলার ইহুদিদের দেশছাড়া করার সময় করেছিল । আমরা আজ -- " মধ্যপ্রাচ্যর নরকে অত্যাচারিত মানুষদের জন্য কান্না করি ,অথচ নিজের ভাইদের কথা ভাবার সময় আমাদের নেই " -- মধ্যপ্রাচ্যর নান্দনিক নরকের মানুষরা নিজ দোষে আজ অত্যাচারীত ,অথচ কাশ্মীরে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত শান্তি প্রিয় পন্ডিতদের কি দোষ ছিল ,যে তাদের এভাবে নিজের ঘর ছেড়ে ,খোলা আকাশে তাবুতে দিন কাটাতে হবে ?
" নিজ ভূমে আজ পরবাসী " -- কাশ্মীরি পন্ডিতদের জন্য আমাদের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে না ,সেখানে মোমবাতি জ্বালানোর মতো কেউ নেই ।হয়তো যেদিন কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিতেরা নিজেদের পরিচয় এবং অস্তিত্ব দুই হারিয়ে ফেলবে ,সেদিন আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচব - " যাক বাবা ঝঞ্জাট গেল "
Comments
Post a Comment