আফগানিস্তান সমস‍্যায় ভারত।ভারতকে নিতে হবে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত।কি হতে পারে তা?

আজকের আফগানিস্তান ও তাতে ভারতের ভূমিকা কি হতে পারে?আজকের পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন অবশ্যই জটিল,তবে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা তো করা যেতেই পারে।

  গনতান্ত্রিক দেশে বসে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না আপনি কতটা ভাগ‍্যবান যে এরকম একটা দেশে বাস করছেন।কারণ পৃথিবীতে এখনো বহু দেশ রয়েছে যে দেশে বসবাসরত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের কোন গ‍্যারান্টি নেই।মৌলিক অধিকার তো ছাড়ুন,তাদের জীবনের‌ই কোন গ‍্যারান্টি নেই।আর আজ এরকম‌ই একটি দেশ হতভাগ‍্য দেশ হল আফগানিস্তান।যে দেশের আজকের হতভাগা জনগন নিজেও জানে না আগামী কাল তার ভবিষ্যৎ কি?

    ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাতক ফোর্সের সদস‍্য

    আফগানিস্তানে আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে বর্তমানে।আফগানিস্তানের বহু প্রত‍্যন্ত জায়গা এখন তালিবানের দখলে।কিন্তু হঠাৎ করে আফগানিস্তানে তালিবানের তৎপরতা এতটা বেড়ে গেল কি করে ?তার জন‍্য আপনাকে কয়েক দশক পিছিয়ে যেতে হবে।

    ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর অন‍্যান‍্য সমস্ত পরাধীন জাতির মতো আফগানিস্তানের শুরুটা হয়েছিল দারিদ্রতা ও অরাজকতার মধ্যে দিয়ে।আফগানিস্তান একটি ল‍্যান্ডলক দেশ হ‌ওয়ায় এবং খনিজ সম্পদের বিশাল প্রাচুর্য না থাকায়,দেশটি কখনই আর্থিক ভাবে স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে নি।এরপর একদিন সাম্রাজ‍্যবাদী আগ্রাসের মুখে পরে আফগানিস্তান।আর এবার তা ছিল সভিয়েত রাশিয়ার রূপে।দেশটি হয়তো সেখানে শেষ হয়ে যেত,যদি না আমেরিকা রক্ষাকর্তা রূপে অবর্তীন না হত।আমেরিকা যত ভালো বা যত খারাপ‌ই হোক না কেন,গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পৃথিবীর কাছে রাশিয়ার থেকে আমেরিকাই বেশি গ্রহনযোগ‍্য ছিল।আমেরিকা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তার চীর প্রতিদ্বন্দ্বী সভিয়েত রাশিয়াকে মাঠ পর্যায়ে পিছু হঠানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ পায় আফগানিস্তানে।পাকাস্তানকে সাথে নিয়ে,আফগান ও পাকিস্তানি ছোট ছোট সভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপ নিয়ে গড়ে তোলে বিশেষ দল,যার নাম তালিবান।এই তালিবান দল গঠনের জন‍্য লোকবল এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন‍্য পাকিস্তান ছিল সহজ ঠিকানা।আমেরিকার CIA বহু টাকা খরচ করে তালিবানদের প্রশিক্ষণ দেয়,তাদের অত‍্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করে।এই তালিবান সভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।সভিয়েত রাশিয়া পরম পরাক্রমশালী হলেও,আশির দশকের শেষে নব্বেইয়ের দশকের শুরুতে যখন তাদের বিশাল আর্থিক মন্দার মধ্যে পরতে হয় এবং সমস্ত ইউনিয়ন ই ভেঙে পরে,তখন আর আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালানোর মতো ইচ্ছা তাদের ছিল না।আর এভাবেই আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া সরে যায়।

   বলা হয়ে থাকে যুদ্ধে ক্ষমতার শূন্য বলয় তৈরী হলে,সেই বলয় পূর্ণ করতে আবারো যুদ্ধ করতে হয়।নব্বেইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানে দুই ধরনের ক্ষমতার আবির্ভাব হয়।তুলনামূলক শক্তিশালী তালিবান শক্তি এবং পশ্চিমা ভাবধারার গনতান্ত্রি মাতাদর্শের শক্তি।তবে সবে যুদ্ধে জয়ী তালিবান‌ই আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে।দীর্ঘ চার পাঁচ বছর তারা আফগানিস্তানে শাষন করে,যাকে বলে শুদ্ধ ইসলামিক শাষন।আর যা ছিল গনতান্ত্রিক মতাদর্শের সম্পুর্ন বিপরীত।আগের মতোই তালিবান তখনো পাকিস্তানের সম্পুর্ন সমর্থন পেতে থাকে,কারণ সেখানে একটা ইসলামী কোণ ছিল।কিন্তু আমেরিকার সাথে তালিবানের দূরত্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে।ব‍্যাপার আরো খারাপ জায়গায় পৌছায়,যখন আমেরিকায় টুইন টাওয়ার জঙ্গি হামলা হয়,আল কায়দা নেতা ওসামা বীন লাদেনের মাধ্যমে।আর তখন আমেরিকা সারা বিশ্বে এক নতুন যুদ্ধ শুরু করে,যা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ নামে পরিচিত।এই যুদ্ধের একটি মূল ভুখন্ড ছিল আফগানিস্তান। যুদ্ধ করে আমেরিকা আফগানিস্তানের শাষন থেকে তালিবানকে উৎখাত করে এবং ২০০৩ গনতান্ত্রিক ভাবধারায় সরকার তৈরী হয় আফগানিস্তানের।

                     আফগান তালিবান

    যে যুদ্ধ ২০০১ সালে শুরু হয় তা আজ‌ও চলছে,কর্থাৎ গনাতান্ত্রিক ভাবধারার বিরুদ্ধে ইসলামিক শাষনের যুদ্ধ।এই পুরোটা সময় আফগানিস্তানে গনতান্ত্রিক সরকার ছিল,আমেরিকা ও ন‍্যাটোর উপস্থিতি আফগানিস্তানে ছিল।দীর্ঘ কুড়ি বছরের এই যুদ্ধে আমেরিকার খরচ হয়েছে প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকা।আমেরিকা ও ন‍্যাটোর প্রায় সাড়ে তিন হাজার সৈনিক মারা গেছে,সাধারণ মানুষ মারা গেছে প্রায় পচাত্তর হাজার,আফগান সৈনিক মারা গেছে প্রায় সত্তর হাজার,তালিবান ও তাদের সঙ্গী দলের সদস্য মারা গেছে প্রায় নব্ব‌ই হাজার।এত যুদ্ধ এত ক্ষয় ক্ষতির পরেও আফগানিস্তানে গনতন্ত্র ছিল।কিন্তু আমেরিকার ট্রাম্প সরকার এসে যুদ্ধের বদলে আলোচনার মাধ‍্যমে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।কারণ আমেরিকা আর বিদেশের যুদ্ধে নিজেদের অর্থ ও সৈনিক ক্ষয় করতে চায় না।শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে 'পিস টক'।আমেরিকা তাদের সৈন্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিতে সম্মত হয়।এর মধ্যে আমেরিকায় বিডেন সরকার আসে এবং গত সপ্তাহে আমেরিকার শেষ সৈনিকটিও আফগানিস্তান থেকে সরে যায়।আর তার পরেই শুরু হয় অরাজকতা।দীর্ঘ কুড়ি বছর তালিবান টিকে থাকলেও,তারা আফগানিস্তানে খুব প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় নি।তাদের অধিকাংশ সময় পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হত,কারণ আমেরিকার আর্মি তাদের আকাশ পথেই খুজে খুজে ধংস করত।কিন্তু এখন আমেরিকা সরে পরতেই তালিবান ক্রমশ পাহাড় জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢোকা শুরু করেছে।আর এখন আফগানিস্তানে তীব্র যুদ্ধ চলছে।

                      আফগান সৈনিক

  আফগানিস্তানে এই অরাজকতার মধ্যে নড়েচরে বসেছে ভারত।কারণ এখানে ভারতের কিছুস্বার্থ রয়েছে।এতদিন আমেরিকার উপস্থিতিতে সেই স্বার্থে ঘা না লাগলেও এবার লাগছে।আর কি সেই স্বার্থ?আফগানিস্তানে ভারতের বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে,যার মাধ‍্যমে ভারত ইরান-আফগানিস্তান হয়ে সরাসরি মধ্যে এশিয়ায় ঢুকতে পারত।তালিবানদের কারণে সেই স্বার্থে ঘা লেগেছে।ভারতের চির শত্রু পাকিস্তানের বন্ধু তালিবান।তালিবান শাষনে এলে ভারতীয় সীমান্তে এবং LOC ভয়ংকর জঙ্গিদের হুমকি বাড়বে।আফগানিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক তিন হাজার বছরের‌ও বেশি সময় ধরে,তাই গনতান্ত্রিক মূল‍্যবোধের আফগানিস্তানকে ভারত হারাতে চাইবে না।তাহলে এখন ভারত কি করতে পারে? ভারতের হাতে কি সত‍্যিই কিছু করার আছে?

   ভারত এই মুহূর্তে পাকিস্তান ও চীন দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের হুমকিতে রয়েছে।ভারত এই দুই ফ্রন্টের যুদ্ধের হুমকিতে আরো একটি ফ্রন্ট খুলতে চাইবে না।কিন্তু আফগান সাধারণ জনগণ থেকে তাদের সরকার পর্যন্ত ভারতের দিকেই চেয়ে রয়েছে।গনতান্ত্রিক মূল‍্যবোধ বাদ দিলেও,মানবিক কারণেও আফগানিস্তানের পাশে ভারতের দাড়াতে হতে পারে।কিন্তু করনীয় কি?ভারত কি আফগানিস্তানে নিজেদের ট্রুপস পাঠাতে সক্ষম?

             LAC তে ভারতীয় সেনাবাহিনী

    কোন ধরনের রিস্ক না নিয়ে ভারত একটি উপায়েই তা করতে পারে।আর তা হল চীনের সাথে একটা সমঝোতায় আসা।চীনের কাছে ধর্মীয় মূল‍্যবোধ বা গনতান্ত্রিক মূল্য বোধের কোন স্থান নেই।তারা লাভ ক্ষতির বিজনেস বোঝে।চীনের সাথে ভারতের সেই পথেই হাঠতে হবে।চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যা ভারতকে দ্রুত মেটাতে হবে।চীনের সাথে এত ঝামেলার মধ্যে ভারত চীন ব‍্যাবসা দিন দিন ক্রমাগত বাড়ছে,চীনকে সেদিকেও নজর দিতে বাধ‍্য করা হবে।আফগানিস্তানে ভারতের যেমন ইনভেস্টমেন্ট আছে,চীনের ও রয়েছে পাকিস্তানে।তাই ভারত নিজেদের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে চিন্তাশীল হলেও,চীন‌ও হবে এটাই স্বাভাবিক।ভারতকে এব‍্যাপারে চীনকে গ‍্যারান্টি দিতে হবে গোপনে হলেও।কারণ পাকিস্তানেও চীনের ইনভেস্টমেন্ট হুমকিতে রয়েছে।

       আফগান ও পাকিস্তানের জনগণের প্রত‍্যাশা

   ভারত যদি চীনের সাথে একটা ফ্রন্ট বন্ধ করতে পারে,তাহলেই আফগানিস্তানে ভারত সরাসরি ভারী মাত্রায় ট্রুপস পাঠাতে পারবে।ভারতকে বিদেশে যুদ্ধের জন‍্য আর্থিক ক্ষতির‌ও খুব একটা চিন্তা করতে হবে বলে মনে হয় না।কারণ ইতিমধ্যেই আমেরিকার সরকার থেকে ইঙ্গিত দিয়েছে,যদিও আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ট্রুপস সরিয়ে নিয়েছে,কিন্তু অন‍্যান‍্য সাহায্য আমেরিকা আগের মতোই আফগানিস্তান কে করবে।ভারত যদি আফগানিস্তানে নিজেদের ট্রুপস পাঠায়,তা আমেরিকার নিজেদের মুখ রক্ষা তেও ভারতকে আর্থিক সাহায্য করবে।কিন্তু সব‌ই নির্ভর করছে ভারত-চীনের সম্পর্কের ওপর।যদি চীন এতে বাগড়া দেয়,তাহলে ভারতকে আফগানিস্তানে নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে ।সেক্ষেত্রে ভারত আফগানিস্তানকে আর্থিক সাহায্য, সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সাহায্য,আর বিশ্ব মঞ্চে গনতান্ত্রিক আফগানিস্তানের পক্ষে নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।

   বৈশ্বিক মাহামারী,আর্থিক মন্দা,চীন সীমান্ত সমস‍্যা,অভ‍্যান্তরীণ নোংরা রাজনীতির মধ্যে ভারতের বর্তমান সরকার চ‍্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।এখন আফগানিস্তান এর সম্পর্কেও ভারতকে বুঝেশুনে এগোতে হবে।কারণ এই ব‍্যাপারে ভারত না বুঝে এগোলে অথবা পিছিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক ভাবে ভারতের ব‍্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে,আর যদি ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত,তাহলে তা বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Comments