যেভাবে চীনের সাবমেরিনারদের মর্মান্তিক সলীলসমাধি ঘটে

 চীনের ভয়ংকর সাবমেরিন দূর্ঘটনা, যা আজ‌ও রহস‍্যজনক !


      চীনের তৈরী মিং ক্লাস Type-035 সাবমেরিন একটি আউটডেটেড দ্বিতীয় প্রজন্মের সাবমেরিন।এটিকে চীন তৈরী করে সভিয়েত রাশিয়ান রোমিও ক্লাস সাবমেরিনের ওপর ভিক্তি করে ,আর সভিয়েত রাশিয়া সেই রোমিও ক্লাস সাবমেরিন

বানায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান Type XXI  ইউ বোটের ওপর ভিক্তি করে।প্রথম দুটি মিং ক্লাস চীন তৈরী করে ১৯৭৫ সালে।কিন্তু চীনের তৈরী এই সাবমেরিন সহজেই সনাক্ত করা যেত জলের মধ্যে,আর এটি এর সমসাময়িক এক‌ই শ্রেণীর অন‍্যান‍্য সাবমেরিন থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল।কিন্তু এটির মান অত্যন্ত দূর্বল হলেও চীন তাদের সমুদ্র সীমার কথা মাথায় রেখে,এর উৎপাদন বন্ধ করতে পারে নি বরং আরো বাড়িয়েছিল।১৯৯০ সাল আসতে আসতে চীন মিং ক্লাসের এই সাবমেরিনের অভ‍্যান্তরে কনট্রোল সিস্টেমের পরিবর্তন আনে এর পর এর নাম দেয় Type-035G Ming-III ক্লাস সাবমেরিন।কিন্তু আপগ্রেডেশনের পর‌ও চীন এই সাবমেরিন গুলিকে গভীর সমুদ্রে ব‍্যাবহার করার ভরসা পেত না,তাই এদের অধিকাংশ সময় চীনের ভূভাগের কাছাকাছি অপারেট করা হত।১৯৯৫ সালে চীন এই আপগ্রেডেড মিং ক্লাসের চারটি সাবমেরিন সার্ভিসে আনে,যাদের সিরিয়াল নাম্বার হল 359,360,361 এবং 362 ।এদেরকে চীনের নর্থ সী ফ্লীটের 12 সাবমেরিন ব্রিগেডে সার্ভিসে আনা হয়।
    ২০০৩ সালের ২৫ শে এপ্রিল ,একটি চীনা মাছ ধরার বোট হঠাৎ‌ই সমুদ্রের জলে একটা ব‍্যাপার খেয়াল করে।তারা দেখে একটি নলের মতো জিনিস (যেটি সাবমেরিনের পেরিস্কোপ ছিল) সেটি সমুদ্রের জলের ওপরে উঠে আছে এবং অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সেটি সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাথে এদিক ওদিক যাচ্ছে।ব‍্যাপারটা মাছ ধরার বোটের জেলেরা দেখার পর চীনা নৌবাহিনীর কাছে রিপোর্ট দেয়।এর পর চীনা নৌবাহিনী সাথে সাথে দুটি জাহাজ পাঠায় ব‍্যাপারটা কি তা তদন্ত করে দেখতে।তদন্তকারী অফিসাররা প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো জাপানি অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার কোন সাবমেরিন যেটি অবৈধ ভাবে চীনা জলসীমায় প্রবেশ করেছে।কিন্তু ভালো করে তদন্ত করে তারা বুঝতে পারে,এটা তাদের‌ই একটি Type-035G Ming-lll ক্লাস সাবমেরিন ,যার সিরিয়াল নাম্বার 361 এবং সেটিতে দূর্ঘটনা ঘটেছে।পর দিন ২৬ শে মার্চ যখন তারা ঐ সাবমেরিনের অভ‍্যান্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়,তখন তারা ভেতরে ৭০ জন চীনা সাবমেরিনারের মৃতদেহ সেখানে দেখতে পায়।
     ২০০৩ সালের ২ রা মে ,চীষের মিলিটারি কমিশনার এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন জনসম্মুখে জানান যে এটি একটি মেকানিক্যাল ফেইলিয়র ছিল,যার ফলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘকে।তার অধীনে চলা তদন্তে  এক মাস পরে তিনি নর্থ সী কমান্ডের কমান্ডার, কমিশনার এবং আরো উচ্চ পদস্থ সাত আট অফিসারকে বহিস্কার করেন।
    কমিউনিস্ট চীন তাদের জন্মলগ্ন থেকেই নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতা এবং ঋণাত্মক দিক সমূহ গোটা পৃথিবীর সামনে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে আসছে।চীনের যাবতীয় মিডিয়া টিভি সব সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়,তাই ঝা চকচকে চীনা শহরের বাইরে যে একটা অতি গরীব চীন বসবাস করে,তা বাইরের পৃথিবীকে দেখানো হয় না।কারন এটি তাদের ইমেজ খারাপ করতে পারে।এক‍ই ভাবে চীন তাদের যেকোন মিলিটারি ফেইলিওর সবসময় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।যদি একটা ফাইটার জেট‌ও ক্রাস করে,সেই খবরটাও বাইরে আসতে দিতে চায়না চীন।আর এত বড় সাবমেরিন দূর্ঘটনার খবর এত সহজেই সবার সামনে তুলে ধরবে চীন,এটা সামরিক বিশেষজ্ঞ দের কাছে ঠিক হজম হয়না।নিশ্চ‌ই এর পিছনের গোপন ব‍্যাপার একটা রয়েছে।
     চীনের এই ভয়ানক সাবমেরিন দূর্ঘটনা নিয়ে অনেক গুলি থিয়োরি সামনে এসেছে।যেহেতু চীন সরকার সরাসরি কিছু প্রকাশ করে নি,তাই এর আসল থিয়োরিটা র্যে কি তা অজানা।
   এই থিয়োরি গুলির মধ্যে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত থিয়োরি,যেটি চীনা সরকারের পরিচালিত মিডিয়া থেকে জানা যায় ,সেটি হল "রেডিও থিওরি" 
     এই থিওরি মতে সাবমেরিন-361একটি ট্রেনিং এক্সারসাইজে অংশ গ্রহন করেছিল বোহাই সমুদ্রে।সাবমেরিনের অভ‍্যান্তরে মোট ৭০ জন সাবমেরিনার ছিল,যাদের অনেকে ছিল ট্রেনি সাবমেরিনার। সাবমেরিনটি জলের অভ‍্যান্তরে সাইলেন্ট রান এর এক্সারসাইজ করছিল,আর তার জন‍্য এর সমস্ত রেডিও সিগনাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।যেহেতু এর রেডিও সিগন্যাল বন্ধ ছিল,তাই এর সাথে ওপর থেকে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।তার পর ভেতরের কোন যান্ত্রিক গোলযোগের ফলে সাবমেরিনের সবাই মারা যায়।
   কিন্তু এই থিওরিতে অনেক সমস‍্যা আছে।যেমন এই সাবমেরিন গুলিতে সাধারণত সর্বাধিক ৫৫-৫৭ জনকে নিয়ে সমুদ্রে যাওয়া হয় ।কিন্তু ঐ দিন সাবমেরিনে ৭০ জন ছিল।হাই র‍্যাঙ্কিং কমোডর চ‍্যাঙ ঐ সাবমেরিনকে লিড করছিল,সাথে আরো উচ্চ পদস্থ অফীসাররা ছিল।সাধারণ ট্রেনিং মিশনে এই ধরনের উচ্চপদস্থ নৌ আধিকারিক রা থকেন না।
   আরেকটি থিওরি মতে চীনা নিন্মানের সাবমেরিনের ব‍্যাটারি এই দূর্ঘটনার মূল কারন।সমুদ্রের জল কোন ভাবে সাবে সাবমেরিনের ব‍্যাটারির অ্যাসিডে মিশে গিয়ে বিষাক্ত ক্লোরিন গ‍্যাস তৈরী হয়েছিল,ফলে সমস্ত সাবমেরিনাররা বিষাক্ত গ‍্যাসে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যান।
    আরেকটি থিওরি তে সাবমেরিনের ইঞ্জিন সমস‍্যাকে দেখানো হয়েছে।ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের ব‍্যাটারি চার্জ করার জন‍্য সমুদ্রের ওপরে অবস্থান করতে হয় অধিকাংশ সময়,কারন ব‍্যাটারি চার্জ করতে ইঞ্জিন চালাতে হয়,আর ডিজেল ইঞ্জিন চালাতে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়,যেটির পরিমান সাবমেরিনের ভেতরে সীমিত হয়।কিন্তু সমুদ্রের ওপরে বিভিন্ন বীপদ থাকায় সাবমেরিন জলের কয়েক মিটার তলায় অবস্থান করে একটি বিশেষ নলের সাহায্য সমুদ্রের ওপর থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে ব‍্যাটারি চার্জ করে ইঞ্জিন চালিয়ে।এই বিশেষ নলটির নাম হল SNORKEL ।এই থিওরি অনুসারে চীনা সাবমেরিনের SNORKEL জলের ওপরে ওঠার পর ,তার নলের ভালব সঠিক ভাবে খুলতে পারে নি বা খোলে নি (এই SNORKEL এমন করেই তৈরী করা হয়,যাতে জলের তলায় ডুব দেওয়ার পর নলের ভালব অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়)। এর ফলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ইঞ্জিনে আসতে পারে নি।অথচ সাবমেরিনের ইঞ্জিন চলমান থাকায়,সাবমেরিনের অভ‍্যান্তরে থাকা সমস্ত অক্সিজেন ইঞ্জিন নিয়ে নেয়।সাধারণত দুই মিনিটের মধ্যে SNORKEL এর মাধ্যমে যা অক্সিজেন নেওয়ার তা নিয়ে নেওয়া হয়,অর্থাৎ SNORKEL এর ভালব বন্ধ থাকার ফলে,ইঞ্জিন বাইরের অক্সিজেন না পেয়ে ভেতরের অবসিষ্ঠ অক্সিজেন দুই মিনিটের মধ্যেই শেষ করে দেয়।আর তাই সাবমেরিন ক্রুরা কোন কিছু করার সুযোগ ও পায় নি।অতিরিক্ত পরিমান সাবমেরিনার বেশি CO2 তৈরী করায় এবং অক্সিজেনের অভাবে ৭০ জন সাবমেরিনারের কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু হয়।
      তবে থিওরি যাই হোক না কেন।অধিকাংশ সাবমেরিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন চীন নিশ্চ‌ই নতুন কিছু খুব গোপনে সমুদ্রের তলায় করতে গিয়ে ছিল।খুব সম্ভবত নতুন AIP সিস্টেমের পরীক্ষা ?হতে পারে ,নাও হতে পারে।তবে যাই করতে যাক না কেনো,তার ফেইলিওরের পর ভয়াবহ ভাবে ৭০ জন মানুষের জীবন দিতে হয়েছে।সাবমেরিন অত‍্যন্ত জটিল একটা যুদ্ধাস্ত্র।এটির সঠিক পরিচর্যা এবং অভিজ্ঞ সাবমেরিনার দ্বারা পরিচালিত করতে হয়,নতুবা এধরনের মারাত্মক মৃত্যু সাবমেরিন দুর্ঘটনায় নিয়মিত ব‍্যাপার হতে পারে।

Comments